আধুনিক বাঙালির আত্মপরিচয়ঃ বঙ্কিম বাবু- নাফিউল হক নাফিউ । প্রবন্ধ । সাহিত্য



ঊনবিংশ শতাব্দী।
একদিকে অন্ধ অনুকরণ পাশ্চাত্য সভ্যতা-সংস্কৃতির, আরেকদিকে গোঁড়ামি-রক্ষণশীলতা হিন্দুত্ববাদীদের। এই দুইয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন বঙ্কিম বাবু।
প্রাচীন ভারতীয় বিদ্যাচর্চা ও পাশ্চাত্য সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা ঊনবিংশ শতাব্দীর বঙ্গীয় রেনেসাঁসের প্রধান দুটি দিক। এই দু’য়েরই মেলবন্ধন ঘটেছে বঙ্গীয় রেনেসাঁসের অন্যতম প্রধান প্রাণপুরুষ বঙ্কিম বাবুর হাতেই। তাঁর জলন্ত প্রমাণ; 'কোঁৎ-মিল-বেন্থাম' পড়া বঙ্কিম বাবুর লেখনীতেই আমরা পেয়েছি ‘কৃষ্ণচরিত্র’।
পাশ্চাত্যে আচ্ছন্ন, আত্মবিস্মৃত বাঙালির স্বদেশীয় শিক্ষা-সংস্কৃতি সম্পর্কে চৈতন্য উদ্বোধনের জন্য ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকা প্রকাশ করেন তিনি, পত্রিকার নামটিও লক্ষণীয়। ‘বঙ্গদর্শনের পত্র-সূচনা’য় তিনি স্পষ্টই বলেছেন —"এই পত্র আমারা কৃতবিদ্য সম্প্রদায়ের হস্তে, আরও এই কামনায় সমর্পণ করিলাম যে, তাঁহারা ইহাকে আপনাদিগের বার্ত্তাবহস্বরূপ ব্যবহার করুন। বাঙ্গালী সমাজে ইহা তাঁহাদিগের বিদ্যা, কল্পনা, লিপিকৌশল এবং চিত্তোৎকর্ষের পরিচয় দিক। তাঁহাদিগের উক্তি বহন করিয়া, ইঁহা বঙ্গ-মধ্যে জ্ঞানের প্রচার করুক।"
বিবিধ প্রবন্ধ দ্বিতীয়ভাগের ‘বিজ্ঞপন’ অংশে বঙ্কিম বাবু জানিয়েছিলেন — "একসময়ে ইচ্ছা করিয়াছিলাম, বাঙ্গালার ঐতিহাসিক তত্ত্বের অনুসন্ধান করিয়া, একখানি বাঙ্গালার ইতিহাস লিখিব।" — ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ লিখিবার ইচ্ছা আসলে বাঙালির আত্মপরিচয় নির্মাণেরই একটি অংশ। সেই ইতিহাস লেখা হয়ে না উঠলেও, বঙ্কিম সেই বিষয়ক বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখেছিলেন বঙ্গদর্শনে।
এই প্রবন্ধগুলির আরও একটা উদ্দেশ্য ছিল — শিক্ষিত বাঙালিকে নিজের ইতিহাস লেখার বিষয়ে উৎসাহিত করা। তিনি নিজেই জানিয়েছেন — "অন্যকে প্রবৃত্ত করিবার জন্য বঙ্গদর্শনে বাঙ্গালার ইতিহাস সম্বন্ধে কয়েকটি প্রবন্ধ লিখিয়াছিলাম।"
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় বঙ্কিমের সাহিত্য সাধনার সূত্রপাত। ললিতা ও মানস কাব্য কীর্তি তাঁর প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন। মধুসূদনের মতাে প্রথম বয়সে বঙ্কিমও ইংরেজীর মােহে বিভ্রান্ত হয়ে ইংরেজী ভাষায় রচনা করেন "Rajmohan’s wife" উপন্যাস। কিন্তু অচিরেই তাঁর মােহভঙ্গ ঘটে। অনাদৃত মাতৃভাষায় তিনি ফিরে আসেন তার প্রতিভা স্পর্শে বাংলা সাহিত্যের শুকনাে খেতে যেন বান ডাকল। সৃষ্টি বৈচিত্রে বাংলা সাহিত্যের ডালি ভরে উঠল। বাঙালি পেল তার আধুনিক আত্মপরিচয়।

লেখকঃ
নাফিউল হক নাফিউ
(কবি, প্রাবন্ধিক)
— সাংস্কৃতিক ও গণমাধ্যম কর্মী।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post