"শেখ কামাল; অকালে ঝরে পড়া এক ধুমকেতু!" || চাঁপাই পোস্ট

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে ব্যবহৃত টয়োটা-৬৮ মডেলের লাল গাড়ীটাই ছিল শেখ কামালের একমাত্র সৌখিন সম্পত্তি। শেখ কামাল ছিলেন সংস্কৃতি জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। এ ক্ষেত্রে তার ছিল ত্রিমুখী প্রতিভা। তিনি একাধারে অভিনয় করতেন, গান গাইতেন এবং সেতার বাজাতেন। শেখ কামাল ছায়নটে সেতার শিখতেন। ছিলেন ঢাকা থিয়েটারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। উপমহাদেশের অন্যতম সেরা ক্রীড়া সংগঠন বাংলাদেশে আধুনিক ফুটবলের প্রবর্তক আবাহনী ক্রীড়াচক্রের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। সে সময়ের জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক সংগঠন স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠীরও প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন তিনি। শেখ কামালকে কখনো ইন করে শার্ট পড়ে ক্যাম্পাসে আসতে দেখা যায়নি। তিনি ওপেন ফুলহাতা টি-শার্ট এবং প্যান্ট পড়তেন, আর পায়ে সাধারণ স্যান্ডেল বা স্যান্ডেল-স্যু। কোনদিন তাকে স্যুট পরতে দেখা যায়নি। তিনি ছাত্রলীগ করতেন; কিন্তু কোনদিন নেতৃত্বের আসনে বসেননি। ৭৫-এর ১৫ই আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন তৎকালীন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জনাব আবুল ফজল। যিনি সে সময়ের এক অনুষ্ঠানে শেখ কামাল-এর প্রশংসা করে বলেছিলেন, "শেখ কামাল ছিল আদর্শবান মানুষ। তাঁর কোন অহংকার ছিল না। অত্যন্ত বিনয়ী ও ভদ্র ছিল।" এই মন্তব্যের কয়েক দিনের মধ্যেই জনাব আবুল ফজল জিয়ার উপদেষ্টা পদ থেকে অপসারিত হয়েছিলেন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর জ্যেষ্ঠ পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল ১৯৪৯ সালের ৫ই আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। বেঁচে থাকলে একাত্তরে রণাঙ্গনের এই যোদ্ধার বয়স হতো বাহাত্তর বছর। শেখ কামাল ১১২-সেগুনবাগিচায় অবস্থিত ডন্স কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ১৯৫৬ সালে কেজি-১ শ্রেণীতে ভর্তি হন। সেই স্কুলে কেজি-১ থেকে কেজি-৩ এবং স্ট্যান্ডার্ড-১ থেকে স্ট্যান্ডার্ড-৩ শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়নের পর ডাবল প্রোমোশন নিয়ে ১৯৬১ সালে বিএএফ শাহীন স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হন। তিনি এই স্কুল থেকে ১৯৬৭ সালে এসএসসি পাশ করেন এবং পরে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। তিনি ১৯৬৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৯ সালে শেখ কামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি স্নাতক (সম্মান) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭৪ সালে স্নাতক (সম্মান) চূড়ান্ত পরীক্ষায় অসুস্থাবস্থায় অবতীর্ণ হয়েও তিনি দ্বিতীয় শ্রেণিতে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং ১৪ই আগস্ট কোর্স সমাপনী মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। শাহাদত বরণের পর ১৯৭৬ সালের ২৯শে জানুয়ারি স্নাতকোত্তর পরীক্ষার ফলাফল বেড়িয়েছিল। এ পরীক্ষাতেও তিনি দ্বিতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। শেখ কামাল ছিলেন সেই ৬১ জন সৌভাগ্যবান তরুণদের একজন, যারা ‘বাংলাদেশ ফার্স্ট ওয়ার কোর্স’ সমাপন করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন লাভ করেন। প্রথম যুদ্ধ প্রশিক্ষণ কোর্সটি ’৭১ সালের জুনের শেষে শুরু হয় এবং একই বছর ৯ই অক্টোবর অংশগ্রহণকারী সদস্যদের ‘পাসিং আউট’ হয়। তিনি সেই প্রশিক্ষণ কোর্সে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি নাট্যচক্রে নিয়মিত রিহার্সেল করতেন এবং সেখানে বেশ কয়েকটি নাটকে অভিনয় করে সংস্কৃতিপ্রেমীদের মাঝে ব্যাপক সাঁড়া ফেলেছিলেন। তার অভিনীত নাটকগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব ম. হামিদের নির্দেশনায় ম্যাক্সিম গোর্কির ‘দি ডেভিল’ অবলম্বনে ‘দানব’, বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’, আল মনসুরের লেখা ‘রোলার এবং নিহত এলএমজি’ এবং ‘আমি মন্ত্রী হব’ অন্যতম। তিনি আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় নাট্য প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করেছিলেন। শেখ কামাল ক্রীড়াবিদ সুলতানা খুকীকে পছন্দ করতেন। তবে পারিবারিক উদ্যোগে বিয়েটা হয়েছিল। খুকীর বাবা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী। দু’ পরিবারের সম্মতিতে ১৯৭৫ সালের ১৪ জুলাই তারা দু’জন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। সংসার যাপন করেছেন মাত্র ২৯দিন। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শহিদ ক্যাপ্টেন শেখ কামাল ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্টে ঘাতকের হাতে নিহত না হলে দেশকে অনেক কিছু দিতে পারতেন তিনি।
ঘাতকের বুলেট শেখ কামালের শারীরিক মৃত্যু ঘটিয়েছে সত্য, কিন্তু তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে আছেন এ দেশের মুক্তিযুদ্ধে, ক্রীড়ায় ও সংস্কৃতিতে। আজ তার ৭২তম জন্মবার্ষিকীতে এই অসামান্য সংগঠক, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বীর মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। লেখক- নাফিউল হক নাফিউ , সদস্য, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, রাজশাহী বিভাগীয় সাংগঠনিক টিম(কমিটি)।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post